বিদ্যানন্দ নিয়ে কিছু কথা
প্রকাশিত : ১৫:০২, ১৭ এপ্রিল ২০২৩ | আপডেট: ১৮:৪৯, ১৭ এপ্রিল ২০২৩
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়ে একজন লেখকের মতামত তুলে ধরা হল।
১. বিদ্যানন্দের পাশে আছি। তাদের অন্যায়, দুর্বলতা, অনিয়ম প্রমাণিত হলে তারা প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে অগ্নিস্নানে শুদ্ধ হয়ে উঠবে, এটাই কাম্য।
২. বিদ্যানন্দের বিষয়ে আমার এটাই প্রথম ও সম্ভবত শেষ পোস্ট। এটা নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ সম্ভব এবং হয়তো উচিতও, কারণ এটা আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, এবং ধর্মনীতির সম্মিলিত ক্রীড়াক্ষেত্রের একটা দুর্দান্ত এবং বড়সড় উদাহরণ।
৩. বিদ্যানন্দের বিপক্ষে ডান ও বাম দুই দলেরই একত্র হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের নতুন কোনো ঘটনা নয়। সাম্প্রদায়িক ও বামপন্থার শক্তি রহস্যজনকভাবে নিজেদের নানা ঘটনাতেই এক কাতারে খুঁজে পায়।
৪. রাষ্ট্র নাগরিকের প্রতিটি বিষয়ের দায়িত্ব নেয় না, নিতে পারে না। নাগরিকের নিজস্ব দায়িত্বও থাকে। এবং পৃথিবীর হেন দেশ নেই, যেখানে নানান মানবিক বিপর্যয়ে ও দুর্যোগে মানুষ নিজেরা এগিয়ে এসে হাত লাগায় না। মূলত এই বিষয়টাই মানুষের মানবিকতার বড় পরিচয়। কখন রাষ্ট্র হাত বাড়াবে, কখন রাষ্ট্রকে বকাঝকা করে কাজ করানো যাবে, দায়িত্বশীল করা যাবে, সেই অপেক্ষায় বসে-থাকা অন্তত আমার কাছে উপযোগী মনে হয় না। ততক্ষণে জান ও মালের প্রভূত ক্ষতিসাধিত হয়। নিজের ঘরে আগুন লাগলে কেউ রাষ্ট্রের অঙ্গসংস্থার আসার অপেক্ষা করে না। এসব নীতিবাক্য উথলিয়া যায় পরের ঘরে আগুন লাগলে। আমিও একমত, রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে এসব করতে। কিন্তু সেটা বিপর্যয়ের ঠিক মুহূর্তে হাতপা ছড়িয়ে বিপলোভী জোশে নয়।
৫. বিদ্যানন্দ সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার শুরু থেকেই হয়ে আসছে। সেক্ষেত্রে শুধু আবেগি ক্রিয়াকলাপের বিপরীতে তাদের আরো গোছানো, সতর্ক, এবং স্বচ্ছ থাকাই উচিত ছিল, যা তারা থাকেনি। এটা সুস্পষ্টভাবে পেশাদারিত্ব, আন্তরিকতা, ও দূরদর্শিতার চরম অভাব। যাঁরা এর ওপরের স্তরে আছেন, তাঁরা নানান দিক থেকে নানাবিধ সহায়তা, এমনকি "রাষ্ট্রীয় পুরস্কার" (একুশে পদক) পাওয়ার পরও এমন ভয়ঙ্কর দুর্বলতা থাকাটা কাজের কথা নয়। বিদ্যানন্দের মত এমন অনেক দানশীল প্রতিষ্ঠান এসবের জন্যে হারিয়ে গেছে। এভাবে চললে বিদ্যানন্দের ভবিষ্যৎও ওরকমই হবে, এটাই ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা।
৬. এবং আবারো প্রমাণিত, ধর্ম কাউকে মহান, উদার, সৎ করে না। প্রচুর নজির দেখছি এমন সব লোকের পোস্টের যারা বিদ্যানন্দ বিপদে ও বেকায়দায় পড়েছে বলে আনন্দিত, কারণ এর সাথে কোনো-না-কোনোভাবে হেঁদুয়ানি জড়িত। বিদ্যানন্দ শত শত গরু কেটে ও হাজার হাজার লোককে গোমাংসসেবা করিয়েও, যদি সত্যি হয়ে থাকে, এই অভিযোগের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। ইস্কন এবং বিদ্যানন্দ যে ভারতীয় গুপ্তসংস্থা রয়ের ইন্ধনে ও নির্দেশে চলছে, এরকমটাই অনেক উচ্চশিক্ষিত লোকজন বিশ্বাস করতে ভালবাসেন, কারণ এমনই তাঁদের ধর্মীয় রাজনৈতিক মানসগঠন। এই কুৎসিত রাজনীতির হাত থেকে ভিন্নতর কেউই রেহাই পায়নি।
৭. বিশেষত পাহাড়ে জায়গাকেনা, সেখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ক্রীত জমি ভিন্ন কাজে ব্যবহার এরকম অভিযোগগুলো অগৌণে ও কঠোরভাবে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাই। বিদ্যানন্দই হোক, আর বিবেকানন্দ, এরকম বিষয়গুলো এড়িয়ে-যাওয়া মানে পাহাড়ের অন্যায়ের পাহাড় আরো বাড়ানো।
৮. যেসব শিশুদের শিক্ষার জন্যে বিদ্যানন্দ কাজ করছে, তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হওয়া জরুরি। বিদ্যানন্দ থাকুক বা না-থাকুক, তাদের জীবন যেন ঝুঁকি ও হুমকিতে না-পড়ে।
৯. শুধু লোকদেখানো চমকের ঠমক নয়, আপামর, যার বিশাল অংশই পামর, জনতার বিশ্বাসার্জনের জন্যে সততা ও নিষ্ঠার বিকল্প নেই। বিদ্যানন্দ সেই পথে না-গিয়ে কাঁদুনি গেয়ে মায়া কাড়তে চাইলে বজ্রপাতই শিরোধার্য হবে এবং অবমানিত হবেন কোটি লোক যাঁরা বিদ্যানন্দের সফলতা কামনা করেছেন, এবং আর্থিক সহায়তা করেছেন কোনো মাত্রায়। এর পেছনের রাজনীতির দাঁতভাঙা জবাব দিতেও এটা দরকারি। কেন বিদ্যানন্দ এই গোড়ার ভিতটা পোক্ত করছে না, সেটা তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। এবং প্রতিষ্ঠানের ও ন্যায়ের ধারাবাহিকতার স্বার্থে তাদের বিবেক সাফ রাখা সবার প্রথম কাজ। সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষের এই লড়াইয়ে তাদের হার অনেক পিছিয়ে দেবে সামগ্রিক মানবিকতার জাগরণ।
১০. বিদ্যানন্দ এবং এরকম সব প্রতিষ্ঠান, যারা মানুষের অর্থ নিয়ে কাজ করে, তাদের মূল ধ্যানজ্ঞান হওয়া উচিত প্রতিটা পাইপয়সার পাই পাই করে হিসেব-রাখা। এর কোনো বিকল্প নেই, কখনোই ছিল না।
লেখক: হিল্লোল দত্ত
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।